মানুষের জীবনযাত্রায় খুব দ্রুতই ডিজিটাল রূপান্তর ঘটছে, যার প্রভাব পড়ছে সামাজিক কার্যক্রমেও। ডিজিটাল প্রবৃদ্ধির গতি-প্রকৃতি বোঝা যায়, এমন সব পরিসংখ্যান ও তথ্য-উপাত্ত অন্তত সে কথাই বলছে। যেমন বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এর ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন মোবাইল ফোনের সিমের মোট সংখ্যা ১৯ কোটি ৩৭ লাখ ৩০ হাজার, এর মধ্যে আবার ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছেন ১৩ কোটি ৮৫ লাখ ৯০ হাজার। ইন্টারনেট ব্যবহারের হার থেকে দেখা যায়, দেশের জনসংখ্যার ৭১ শতাংশ মানুষই এ সুবিধা গ্রহণ করছেন। স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ার কারণে আবার দেশের ২৯ শতাংশ মানুষ বিভিন্ন ধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করছেন। এর মানে দেশে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়মিত ব্যবহার করছেন, এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি।
ইন্টারনেটের ব্যবহার যেমন বেড়েছে, সেই সঙ্গে বেড়েছে প্রযুক্তির সহায়তায় হয়রানিও। এ ক্ষেত্রে বয়স, শ্রেণি, পেশার ভেদাভেদ না থাকলেও সবচেয়ে বেশি হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হচ্ছেন নারীরা। বর্তমানে আমাদের দেশের নারীরা যেমন পরিবারে ও সমাজে অপরাধ ও অন্যায়ের শিকার হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি শিকার হচ্ছে অনলাইন মাধ্যমগুলোতে। ইন্টারনেটে আপত্তিকর ছবি বা ভিডিও ছেড়ে দেওয়া, গোপন তথ্য বা একান্ত ব্যক্তিগত কথা বা ছবি ফাঁস, ব্ল্যাকমেইল করে টাকা হাতিয়ে নেওয়া, আইডি হ্যাক করা, যৌন নিপীড়নমূলক বার্তা পাঠানো, ঘৃণ্য ও আপত্তিকর মন্তব্যের শিকার হচ্ছে নারীরা। সাইবার জগতের নতুন ফাঁদ ‘ডিপফেক’ ভিডিও বা ছবি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) সহায়তায় ভুয়া ভিডিও ও ছবি বানিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত আমাদের দেশের কিশোরী ও নারীদের হেনস্তা করা হচ্ছে।
এ যেন দেশের ডিজিটাল অগ্রযাত্রার চিত্র থেকে একদম আলাদা কোনো প্রেক্ষাপট। এতে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নারীর অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে অর্থনীতি, ডিজিটাল অগ্রযাত্রাসহ দেশের উন্নয়নের সব ক্ষেত্রে । কেননা দেশের অর্ধেক জনসংখ্যাকে অনলাইনে অনিরাপদ রেখে অগ্রগতির কোনো লক্ষ্য পূরণ করাই সম্ভব নয়। তাই প্রযুক্তি -সহায়তা লিঙ্গ ভিত্তিক সহিংসতা সম্পর্কে ব্যাপক সচেতনতা বাড়ানো এবং সশ্লিষ্ট অংশীজন তথা সরকারি-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান, নাগরিক সংগঠন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, জনপ্রতিনিধি, নীতি-নির্ধারক এবং গণমাধ্যমের ভ‚মিকা জোরাল করার মাধ্যমে আমাদের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে সকলের বিশেষ নারীর জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করা ভীষণভাবে জরুরী ।
ঢাকা, ১২ জুন ২০২৪:
প্রযুক্তির সহায়তায় সংঘটিত জেন্ডার-ভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধে জনসচেতনতা বাড়ানো এবং সশ্লিষ্ট অংশীজন তথা সরকারি-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান, নাগরিক সংগঠন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, জনপ্রতিনিধি, নীতি-নির্ধারক এবং গণমাধ্যমের ভূমিকা জোরালো করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ এনজিওস নেটওয়ার্ক ফর রেডিও এন্ড কমিউনিকেশন (বিএনএনআরসি)-এর উদ্যোগে ১২ জুন ২০২৪ বুধবার ‘ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন প্রক্রিয়ায় জেন্ডার সমতা নিশ্চিতকরন: প্রযুক্তির সহায়তায় সংঘটিত জেন্ডার-ভিত্তিক সহিংসতা মোকাবিলায় কমিউনিটি রেডিও সম্প্রচার’ শীর্ষক একটি অনলাইন ট্রেনিং অব ফ্যাসিলেটেটরস্ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
উক্ত ট্রেনিং অব ফ্যাসিলেটেটরস্-এর উদ্দেশ্য ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন প্রক্রিয়ায় জেন্ডার সমতা নিশ্চিতকরণ: প্রযুক্তির সহায়তায় সংঘটিত জেন্ডার-ভিত্তিক সহিংসতা মোকাবিলায় সম্পর্কে কমিউনিটি রেডিও’র সম্প্রচারকারীদের ধারনা প্রদান, সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের তথা সরকার, প্রযুক্তি কোম্পানী, নিয়ন্ত্রনকারী কমিশন, কমিউনিটি রেডিওসহ গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজ সংগঠনের করনীয় সম্পর্কে আলোকপাত করা এবং কমিউনিটি রেডিও’র করনীয় নির্ধারণে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণে রেডিও’র সম্প্রচাকারীদের সচেষ্ট করা।
ট্রেনিং অব ফ্যাসিলেটেটরস্-এ দেশের ১৯ কমিউনিটি রেডিও এবং ২টি কমিউনিটি অনলাইন রেডিও’র মোট ৪০ জন স্টেশন ম্যানেজার ও সিনিয়ির সম্প্রচাকারীবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন।
ট্রেনিং-এ মূলত প্রযুক্তির সহায়তায় জেন্ডার-ভিত্তিক সহিংসতা কী,এর ধরন, প্রভাব এবং প্রযুক্তির সহায়তায় জেন্ডার-ভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের তথা সরকার, প্রযুক্তি কোম্পানী, নিয়ন্ত্রনকারী কমিশন, কমিউনিটি রেডিওসহ গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজ সংগঠনের করনীয় সম্পর্কে আলোচনা করা হয় এবং ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন প্রক্রিয়ায় জেন্ডার সমতা নিশ্চিতকরণ: প্রযুক্তির সহায়তায় সংঘটিত জেন্ডার-ভিত্তিক সহিংসতা মোকাবিলায় কমিউনিটি রেডিও’র কর্ম পরিকল্পনা নির্ধারন করা হয়। মূল আলোচনা পর্ব পরিচালনা করেন জনাব এএইচএম বজলুর রহমান, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, বিএনএনআরসি এবং জনাব হীরেন পন্ডিত, সমন্বয়কারী, বিএনএনআরসি ।
ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন প্রক্রিয়ায় জেন্ডার সমতা নিশ্চিতকরণ: প্রযুক্তির সহায়তায় সংঘটিত জেন্ডার-ভিত্তিক সহিংসতা মোকাবিলায় কমিউনিটি
রেডিও’র সম্প্রচার এ বিষয়ক মুক্ত আলোচনা অধিবেশনে, অংশগ্রহণকারীরা তাদের করনীয় এবং কর্ম পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেন। তাদের প্রস্তাবিত উল্লেখ্য যোগ্য কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে, রেডিও স্টেশন পর্যায়ে সকল সম্প্রচারকারীদের অংশগ্রহণে জেন্ডার রিলেশনশিপ ও ডেভেলপমেন্ট এবং প্রযুক্তির সহায়তায় সংঘটিত জেন্ডার-ভিত্তিক সহিংসতা মোকাবিলায় বিষয়ক ওরিয়েন্টশন কর্মশালার আয়োজন, রেডিও’র চলমান কার্যক্রম যেমন- লাইভ অনুষ্ঠান, উঠান বৈঠক, শ্রোতাক্লাব, টকশো, পিএসএন, ম্যাগাজিন, নাটিক, রেডিও স্পট ইত্যাদিতে প্রযুক্তির সহায়তায় সংঘটিত জেন্ডার-ভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধে সচেতনতামূলক তথ্য প্রদান, স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন অংশীজন যেমন- সরকারি-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, সেবা প্রদানকারী নাগরিক সংগঠন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, জনপ্রতিনিধি, যুব সংগঠন প্রতিনিধি, শিক্ষক, অভিভাবক ইত্যাদি অংশগ্রহণে সংলাপ আয়োজন এবং তাদের রেডিও অনুষ্ঠানে যুক্তকরন, পাশাপাশি রেডিও’র স্যোশাল মিডিয়ায় প্রযুক্তির সহায়তায় সংঘটিত জেন্ডার-ভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধ বিষয়ক সচেতনতামূলক রীলস্, ভিডিও, পোস্ট এবং সাক্ষাৎকার প্রচার।
আশা করা হচ্ছে উক্ত ট্রেনিং অব ফ্যাসিলেটেটরস্-এর মাধ্যমে দেশের ১৯ কমিউনিটি রেডিও এবং ২টি কমিউনিটি অনলাইন রেডিও’র অংশগ্রহণকারী মোট ৪২ জন স্টেশন ম্যানেজার ও সিনিয়ির সম্প্রচাকারীবৃন্দ ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন প্রক্রিয়ায় জেন্ডার সমতা নিশ্চিতকরণ: প্রযুক্তির সহায়তায় সংঘটিত জেন্ডার-ভিত্তিক সহিংসতা মোকাবিলায় সম্পর্কে ধারনা পাবেন যা তাদের ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতন ও দক্ষ করবে। পাশাপাশি এই ৪২ জন সম্প্রচারকারীর মাধ্যমে রেডিও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যক্তিদের মধ্যেও বিষয়টি সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি হবে। এছাড়া কমিউনিটি রেডিও’র কর্ম পরিকল্পনা নির্ধারণ এবং তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে কমিউনিটি পর্যায়ে প্রযুক্তির সহায়তায় সংঘটিত জেন্ডার-ভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি হবে।
উল্লেখ্য ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন প্রক্রিয়ায় জেন্ডার সমতা নিশ্চিতকরণ: প্রযুক্তির সহায়তায় সংঘটিত জেন্ডার-ভিত্তিক সহিংসতা মোকাবিলায় সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিএনএনআরসি জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে প্রচারাভিযান শুরু করেছে। এরই অংশ হিসেবে উক্ত ট্রেনিং অব ফ্যাসিলেটেটরস্-এর আয়োজন। এছাড়া প্রচারাভিযানের অন্যান্য কার্যক্রমগুলো হল- কমিউনিটি ভিত্তিক, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে সংলাপের আয়োজন, গণমাধ্যমে কর্মরত সকল সাংবাদিক, নাগরিক সংগঠনের প্রতিনিধি, প্রযুক্তি বিষয়ক কোম্পানী, নারী অধিকার বিষয়ক সংগঠনের প্রতিনিধি, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিভাগের প্রতিনিধি, রেগুলেটরী কমিশন ও এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বহুমাত্রিক অংশীজনদের নিয়ে জেলা, বিভাগ ও জাতীয় পর্যায়ে সকলের করণীয় সম্পর্কে ওপেন ডায়ালগের আয়োজন। এছাড়াও প্রযুক্তির সহায়তায় জেন্ডার-ভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও প্রতিহতকর বিষয়ক বিভিন্ন উপকরণ তৈরি এবং সংশ্লিষ্ট অংশীজন তথা-দাতা সংস্থা, পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগ, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রেরণ এবং তাদের চলমান কার্যক্রমের সাথে সমন্বয়করণের বিষয়ে আলোচন। পাশাপাশি একটি প্রশিক্ষণ মডিউল তৈরি যেখানে লিগ্যাল মেজারস, প্রটেকশন এন্ড রেমিডিস, মেজারস টু সাপোর্ট এন্ড এমপাওয়ার সারভাইভারস, ক্যাপাসিটি বিল্ডিং ইনক্লুডিং অফ আদার এনজিওস এন্ড এক্টরস ইন দি ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম, কমিউনিটি এনগেজমেন্ট এন্ড এডুকেশন, এডভোকেসি এন্ড কালেকটিভ একশন, পার্টনারশীপ এন্ড কোলাবোরেশন এক্রস সেক্টর ইত্যাদি বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে ।
উল্লেখ্য বিএনএনআরসি একটি গণমাধ্যম উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা যা ২০০০ সালে আত্ম প্রকাশ করে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন এনজিও বিষয়ক ব্যুরো থেকে নিবন্ধিত। এটি জাতিসংঘের ইকোনোমিক এন্ড সোশ্যাল কাউন্সিল এর বিশেষ পরামর্শক মর্যাদা প্রাপ্ত সংস্থা এবং সংস্থাটি তথ্য সমাজ বিনির্মাণে অবদানের জন্য ওয়ার্ল্ড সামিট অন ইনফরমেশন সোসাইটি জাতিসংঘের পুরস্কার-২০১৬ এর বিজয়ী এবং ২০১৭ এবং ২০১৯, ২০২০, ২০২১ এবং ২০২৩- এর চ্যাম্পিয়ন ।
বিএনএনআরসি নলেজ-ড্রাইভেন মিডিয়া ডেভেলপমেন্ট-এর ভূমিকায় দেশীয় আঞ্চলিক, ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে কাজ করে থাকে। বিএনএনআরসির কর্মপ্রচেষ্টা হলো গ্রামীণ জনপদে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর তথ্য অধিকার, সুশাসন এবং মানবাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশে গণমাধ্যমের দ্রুত পরিবর্তনশীল বাস্তবতার চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ-সুবিধাসমূহ বিবেচনায় রেখে জ্ঞানভিত্তিক ও চলমান ইস্যু বিবেচনায় রেখে গণমাধ্যমের উন্নয়ন।